২১শে ফেব্রুয়ারিতে পালং হাইস্কুলে–
যার বিয়ে তার খবর নাই, পাড়া পরশির ঘুম নাই!
১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারিতে ভাষা আন্দোলনে পালং হাই স্কুলের ভূমিকা নিয়ে ফেইসবুক/ মিডিয়াতে নাবালক লেখকরাই লিখছে ইতিহাস। যারা দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়তো তাদেরকে আলিবাবার রসের গল্পের মতো উপস্হাপন করছে ভাষা সৈনিক হিসেবে, আবার অনেকেই গোষ্ঠীতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় মরিয়া।
আমি জীবিত থাকতে যদি এই দশা হয়, পরবর্তী প্রজম্ম ভুল ইতিহাস জানবে, তাই এখনই সময় সত্য প্রকাশের।
…
১৯৪৭ সালে আমি ও আমার বড় ভাই সালেহ আহমদ চৌধুরি ৫ম শ্রেণিতে পালং হাই স্কুলে ভর্তি হই। আমার আরেক বড় ভাই জাফর আলম চৌধুরি তখন আমাদের উপরের ক্লাসে পড়তেন। উনার সহপাঠী ছিল ড. মীর কাশেম(চাকবৈঠা), ফজল করিম মাস্টার। তখন ৫ম শ্রেণি ছিল হাইস্কুলে। প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিল ৪র্থ শ্রেণি পর্যন্ত।
আমার সহপাঠী ছিল প্রেমানন্দ বড়ুয়া( রত্নাপালং), নীরোদ বড়ুয়া(রুমখা), সাধন দে আর উনার ভাই কৃষ্ণ দে(উখিয়া), গোলাম বারী Survey আমিন(কামারিয়া বিল), আবদুল আজিজ মেম্বার(সোনার পাড়া), ইব্রাহিম মাষ্টার(ইনানি), ডা: রশিদ( হোয়াইক্যং), আইয়ুব আলি মাস্টার( শাহপরীর দ্বীপ), ললিত বড়ুয়া(ভালুকিয়া), জাকারিয়া( পোকখালী), বদি আলম মাস্টার(গোয়ালিয়া), মোস্তাক মুন্সি(হলদিয়া), জলিল আহমদ( ক্লাস পাড়া), আবদুল হক চেয়ারম্যান(ইনানি), আবুল কাশেম-সুপার পি টি আই( ভালুকিয়া), বশি উল্লাহ মাস্টার( নিদানিয়া), কাশেম আলি( আলাউদ্দিন মুন্সির চাচা), মোক্তার আহমদ (ক্লাস পাড়া), লোকমান হাকিম মাস্টার।
তখন হোস্টেলে থাকত অধিকাংশ টেকনাফের ছেলে।
আব্দুর শুক্কর-জাফর চেয়ারম্যানের ছেলে(কানজর পাড়া), এজার চৌধুরি, কাশেম( হ্নীলা), আশরাফ আলি, আলি মিয়া চৌধুরি, আব্দুর রাজ্জাক ও উনার ভ্রাতা কাদের, টেকনাফের সফর আলি ও রশিদ- কবির মিয়ার বাড়িতে লজিং থাকত।মইন উদ্দিন (হ্নীলা), আবদুল গফুর(হ্নীলা), কাশেম( হ্নীলা)।
১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি রাজধানী ঢাকায় রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবির মিছিলে খুনী নুরুল আমিন সরকারের নির্দেশে গুলি করে ছাত্র হত্যার খবরটি ঐদিন রাতে পালং এর ঘরে ঘরে পৌঁছে যায়।
২২ ফেব্রুয়ারি প্রতিদিনের মতো পালং উচ্চ বিদ্যালয়ে এসে স্কুলের সহপাঠী বন্ধুদের সাথে আলাপ, তৎক্ষনাৎ ক্লাস বর্জন করে ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে মিছিল ও উখিয়া থানা ঘেরাও করার সিদ্ধান্ত নিই।
সিদ্ধান্ত মোতাবেক আমি বাদশা মিয়া চৌধুরী ও স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র মোহাম্মদ জাকরিয়া (শিক্ষক, বর্তমানে প্রয়াত) এর নেতৃত্বে পালং হাই স্কুলের শতাধিক শিক্ষার্থী নিয়ে মিছিল সহকারে আরাকান সড়ক হয়ে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ শ্লোগানে শ্লোগানে পায়ে হেঁটে উখিয়া থানা স্টেশনে পৌঁছাই। মিছিলকারীদের পক্ষ থেকে উখিয়া থানায় কর্মরত পুলিশ সদস্যদেরকে জানানো হয় ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলার সমর্থনে আপনারা আপনাদের কার্যক্রম বন্ধ করে আমাদের আন্দোলনকে সমর্থন করুন। নতুবা থানা উড়িয়ে দেয়া হবে’।
পরক্ষণে থানায় কর্মরত পুলিশ সদস্যরা সমর্থন জানালেও মিছিলটি উখিয়া স্টেশন ঘুরে এসে দেখা যায় থানার পুলিশ কথা রাখেনি, তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।
এ অবস্থায় মিছিলকারীরা থানায় গিয়ে লাথি মেরে থানার কাঠের দরজা বন্ধ করে।কাঠের দরজায় লাঠির আঘাত করতে থাকে। অসংখ্য লাঠির আঘাতে থানার কাঠের দরজা ফাটল হয়ে যায়।’ দীর্ঘদিন যাবৎ উক্ত ফাটলকৃত কাঠের দরজা ভাষা আন্দোলনের আলামতের স্মৃতি চিহ্ন হিসেবে বহাল ছিলো।
তখন উখিয়া স্টেশনে জনতার উদ্দেশে বাংলা ভাষার গুরুত্ব ও তাৎপর্য সম্পর্কে ধারণা এবং রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানিয়ে বক্তব্য রাখি আমি বাদশাহ মিয়া চৌধুরী(সাবেক চেয়ারম্যান হলদিয়া পালং ও বীর মুক্তিযোদ্ধা), মোহাম্মদ জাকারিয়া, নিরোধবরণ বড়ুয়া, প্রিয়দর্শী বড়ুয়া, ললিত বড়ুয়া প্রমুখ।
ওই সমাবেশে ছাত্র হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি এবং রাষ্ট্রভাষা বাংলা আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয়া হয়।
এছাড়া মিছিলে ছিলেন আমার ভাই ছালেহ আহমদ চৌধুরী, প্রিয়দর্শী বড়ুয়া, এ কে আহমদ হোসেন (পরবর্তীতে এডভোকেট), আয়ুব আলী, রশিদ আহমদ সহ আরো অনেকেই।
সে সময় স্কুলে প্রধান শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন চট্টগ্রাম জেলার বোয়ালখালী উপজেলার কাননুগোপাড়া নিবাসী লোকনাথ দে। ছাত্রদের ক্লাশ বর্জন, বিক্ষোভ মিছিল সমাবেশে শিক্ষকদের মৌন সম্মতি ছিলো এবং স্কুলে পড়ুয়া শতাধিক ছাত্র মিছিলে অংশ নিয়ে আমাদের সমর্থন দেয়।
লেখক — বাদশাহ মিঞা চৌধুরী, উখিয়া।